মধু। কালোজিরা মধু খাওয়ার নিয়ম। মধুর উপকারিতা
মধু
মধু একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি জাতীয় তরল পদার্থ, যা মৌমাছি বিভিন্ন ধরনের ফুল থেকে সংগ্রহ করে তৈরী করে থাকে। মধু শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়, প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। মধু প্রাচীন কাল থেকেই ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
প্রাকৃতিক মধুর উৎস বা মধুর প্রকারভেদ
প্রত্যেক ফুলের যেমন ঘ্রাণ আলাদা, তেমনি ঐ ফুলের রসের স্বাদ ও আলাদা। মৌমাছি ভিন্ন ভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে, এজন্য মধু কয়েক রকমের হয়ে থাকে। নিচে মধুর প্রকারভেদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
- সরিষা ফুলের মধু
- সুন্দরবনের মধু
- কালোজিরা ফুলের মধু
- লিচু ফুলের মধু
- বনজ মধু
- নেপালের রহস্যময় পাগলা মধু
সরিষা ফুলের মধু
বাংলাদেশে যে কয়েক রকমের মধু পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মধু হলো সরিষা ফুলের মধু। সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ বক্স বসানো হয়, যাতে করে মৌমাছি খুব সহজেই সরিষা ফুল থেকে ফুলের রস সংগ্রহ করতে পারে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি হয় এই মধু। উৎপাদন বেশি হওয়ায় অন্যান্য মধুর থেকে এই মধুর দাম কম হয়ে থাকে।
সুন্দরবনের মধু
সুন্দরবনের মধু হলো বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত প্রাকৃতিক সম্পদ। সুন্দরবনের মৌচাক থেকে এই মধু সংগ্রহ করা হয়। এই মধু তার নিজস্ব স্বাদ, গন্ধ এবং ঔষধি গুনের জন্য বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে।
সাধারণত মার্চ - এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর - নভেম্বরে এই মধু সংগ্রহ করা হয়। কারণ, এই সময়ে সুন্দরবনে ফুলগাছের ফুলগুলোতে প্রচুর রস থাকে। স্থানীয় লোকেরা জীবনের ঝুকি নিয়ে এই মধু সংগ্রহ করে থাকে।
কালোজিরা ফুলের মধু
কালোজিরা ফুলের মধু আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ভেষজ গুণাবলির জন্য এই মধু চাহিদাসম্পন্ন। কালোজিরা ফুলের মধু দেখতে কালো রঙের হয়। এই মধুর স্বাদ কিছুটা গুড়ের মতো। সাধারণত যেসব এলাকায় কালোজিরা চাষ হয়, সেখানে মৌ খামারিরা মৌ চাক নিয়ে চলে যায়। তারপর কালোজিরা ক্ষেতের পাশে মৌ বক্স রেখে দেওয়া হয়। ফলে মৌমাছি রা সহজেই কালোজিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারে।
লিচু ফুলের মধু
এই মধু লিচু গাছের ফুল থেকে মৌমাছিরা সংগ্রহ করে থাকে। লিচু গাছে যখন ফুল আসে খামারিরা তখন মৌ বক্স লিচু বাগানে বসি দেয়, এতে করে মৌমাছিরা সহজেই লিচু গাছের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে। লিচু ফুলের মধু বাংলাদেশ সহ ভারত ও নেপালেও বেশ জনপ্রিয়।
বনজ মধু
বনজ মধু হলো মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে তাদের মৌচাকে জমা করে, এরপর মাওয়ালী রা এরকম মৌচাক খুঁজে খুঁজে সেসব মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে।
নেপালের রহস্যময় পাগলা মধু
এই মধু প্রাকৃতিক অন্যান্য মধুর মত নয়। এই মধু খেলে হ্যালুসিনেশন হয়। এই মধু শুধুমাত্র নেপালে পাওয়া যায়। এই মধু খাওয়ার পর এক ঘোর লাগা অবস্থার সৃষ্টি হয়, একারণে এই মধুর নাম হয়ে গেছে 'নেপালি ম্যাড হানি'। মানে, নেপালের পাগলা মধু।
নেপালের পাগলা মধুর বিস্তারিত নিয়ে আমাদের ওয়েবসাইটে আলাদা একটি পোস্ট করা আছে।
খাটি মধু চেনার উপায়
সব মধু দেখতে প্রায় একই রকম হওয়ায় খাটি মধু চেনা সহজ নয়। আমাদের মনে অনেক সময় প্রশ্ন জাগে, বাজার থেকে আমরা যেই মধু কিনছি তা কতটুকু ভেজাল মুক্ত? ভেজাল হিসেবে মধুর সাথে পানি, চিনি সহ আরো অনেক কিছু মেশানো হয়।
মধু খাটি নাকি ভেজাল সেটা ১০০% নিশ্চিত হওয়ার ঘরোয়া কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নেই। তারপরও আমাদের দেশে ইউটিউবে খাটি মধু যাচাইয়ের কিছু ঘরোয়া, সনাতনী পদ্ধতি দেখানো হয়। যেমনঃ
- পানি দিয়ে খাটি মধু পরীক্ষা
- আগুন দিয়ে খাটি মধু পরীক্ষা
- কাগজ দিয়ে খাটি মধু পরীক্ষা
- আঙ্গুল দিয়ে খাটি মধু পরীক্ষা
আমি মনে করি, এভাবে ১০০% খাটি মধু পরীক্ষা করা যায় না। শুধুমাত্র ল্যাব টেস্ট, মাইক্রোস্কোপ ইত্যাদি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে / একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে খাটি মধু যাচাই করা যায়। প্রয়োজনে যেকোনো মধু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
কোন ফুলের মধু সবচেয়ে উপকারি বা ভালো?
বাংলাদেশে অনেক ফুলের মধু পাওয়া যায় এবং প্রত্যেকটা ফুলের মধুর ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ রয়েছে। এজন্য অনেকেই বুঝতে পারে না যে, তার কোন মধু কেনা উচিৎ। চলুন জেনে নেওয়া যাক
প্রতিটি ফুলের মধুই ভালো, প্রতিটি ফুলের মধুই উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীর যত ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়, তার সবগুলো উপাদান প্রাকৃতিকভাবে মধুর সাথে মিশে যায়। কিন্তু বাহ্যিকভাবে আমরা বিভিন্ন রঙ, বিভিন্ন ঘনত্ব, বিভিন্ন স্বাদের মধু দেখতে পাই। আসলে সময়, কাল, স্থান ভেদে মধুর এরকম আচরণ লক্ষ করা যায়। কিছু কিছু মধুর হালকা রঙ হয়ে থাকে, আবার কিছু মধুর ঘনত্ব অনেক বেশি হয়ে থাকে, আবার কিছু মধু একেবারে জমে যায়। এর মানে এটা নয় যে, মধুটা ভেজাল বা কম উপকারি।
মধু কেনার সময় আমার খেয়াল রাখতে হবে, মধু টা অবশ্যই Raw Honey অর্থাৎ কাচা মধু হতে হবে। আমরা অনেকেই মনে করি, কাচা মধু হয়তো ভালো হবে না, স্বাস্থ্যের জন্য অপকারী হতে পারে। এসব ভেবে আমরা বাজার থেকে Processed Honey বা প্যাকেটজাত মধু কিনে থাকি। এটা আসলে সম্পূর্ণ আমাদের ভুল ধারণা। মধু থেকে সবচেয়ে বেশি উপকার পেতে হলে সেই মধুটা অবশ্যই ভালো মানের কাচা মধু হতে হবে। সেটা যেকোনো ফুলের মধু হতে পারে। ভালো মানের, Raw/কাঁচা মধু হলেই হবে।
মধুর সাথে কালোজিরা খেলে কি হয়?
আজ থেকে আরো কয়েক হাজার বছর পূর্বে ইউনানি চিকিৎসা শাস্ত্রে কালোজিরা এবং মধুর ঔষধি উপকারিতা উল্লেখ করা হয়েছে। মেডিকেল সাইন্স এর জনক 'ইবনে সিনা' ও বলেছেন সকালে খালিপেটে কালোজিরা ও মধু খেলে শরীরে আশ্চর্য কিছু উপকার হয়।
কালোজিরা বা Nigella sativa আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারি জিনিস। কালোজিরা কে বলা হয় মৃত্যু ব্যতীত যাবতীয় সকল রোগের ঔষধ। মধুর সাথে কালোজিরা খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে।
প্রতিদিন সকালে ১চা চামচ মধুর সাথে ১/২চা চামচ কালোজিরা একসঙ্গে মিশিয়ে সেবন করতে হবে।
সন্ধ্যায় ১ গ্লাস দুধের সাথে ১/২চা চামচ কালোজিরা গুড়ো মিশিয়ে খেতে পারেন। দুধ কুসুম গরম থাকা অবস্থায় এরমধ্যে ১চা চামচ মধু মিশিয়ে নেবেন।
মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম
বিশ্ব নবী আমাদেরকে মধু খেতে বলেছেন। মধুর উপকারিতা অনেক। আল্লাহর রাসুল নিজেও মধু খেতেন।
মধু খাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। আপনি শুধু মধুও খেতে পারেন, আবার সেটা কোনো কিছুর সাথে মিশিয়েও খেতে পারে। অনেকে দুধের সাথে মধু মিশিয়ে খায়, অনেকে মধুর সাথে কালোজিরা মিশিয়ে খায়, অনেক মধুর সাথে চিয়া সিড মিশিয়ে খায়। আপনি যেকোনো ভাবে মধু খেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, আপনি যে মধু খাচ্ছেন সেটা খাটি মধু হতে হবে এবং মধুর সাথে যেটা মিশিয়ে খাবেন, সেটাও খাটি / পিওর হতে হবে।
মধু খাওয়ার উপকারিতা
মধু খাওয়ার নানা উপকারিতা রয়েছে, যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। নিচে কয়েকটি মধুর উপকারিতা উল্লেখ করা হলোঃ
- শরীরের শক্তি বাড়ায়
- হজমে সহায়তা করে
- ওজন কমাতে সাহায্য করে
- শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
- যৌন দুর্বলতা কাটাতে
- রূপচর্চায়
- গলার স্বর ভালো করতে
- আমাশয় ও পেটের পীড়া নিরাময়ে
- হাঁপানি রোধে
- উচ্চ রক্তচাপ কমায়
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
রূপচর্চায় মধুর ব্যবহার
মধু শুধু খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, রূপচর্চায় ও মধু ব্যবহারের অনেক উপকারিতা রয়েছে। মধু একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যন্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। রূপচর্চায় মধুর কিছু সাধারণ ব্যবহার নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
- ত্বকের দাগ কমাতে মধু ও লেবুর ফেসপ্যাক
- ত্বককে মসৃণ করতে মধু ও টমেটোর ফেসপ্যাক
- ত্বক আর্দ্র রাখতে মধু ও দুধের প্যাক
- ত্বকের তেল শোষণ ও ত্বককে পরিষ্কার রাখতে মধু ও দারুচিনি
- ত্বকের ফোলা-ভাব কমাতে মধু ও অ্যালোভেরা
- শুষ্ক ত্বক দূর করতে মধু ও জলপাই তেল
- ত্বক উজ্জ্বল করতে মধু ও চন্দন
- ত্বককে হাইড্রেটেড রাখতে মধু ও বেসন
এছাড়াও আরো বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন উপায়ে রূপচর্চায় মধুর ব্যবহার হয়ে থাকে।
এখানে কমেন্ট করুন
comment url