ঈল মাছ (Eel fish) যৌবন ধরে রাখে কোটি টাকা দামের মাছ
ঈল মাছ (Eel fish)
ঈল মাছ (Eel fish) লম্বা, সরু / চ্যাপ্টা ও সাপের মতো দেখতে হয়। এদের ত্বক মসৃণ, শরীরে আঁশ থাকেনা বললেই চলে। অনেকে প্রথম দেখায় এটিকে সাপ বলে মনে করেন। কিন্তু এটা আসলে কোনো সাপ না। বিশ্বের কোনো কোনো জায়গায় সোনার মতো দামি এই Eel fish.
Eel fish কি সত্যিই যৌবন ধরে রাখে?
পোস্টসূচীপত্রঃ জাপানে অনেক বিখ্যাত এই মাছ। জাপানিরা শরীরকে চাঙ্গা রাখতে এবং শক্তি বর্ধক হিসেবে খেয়ে থাকেন এই মাছ। এমনকি ঈল মাছ বয়সের ছাপ কমিয়ে যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে বলে মনে করেন তারা। ঈল মাছে থাকা কিছু প্রাকৃতিক উপাদান যা, আমাদের শরীরে শক্তি জোগায়, হাড় শক্ত করে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে এবং বয়সের ছাপ দূরে ঠেলে যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ঈল মাছের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
বিশেষজ্ঞদের মতে Eel fish অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। এতে উচ্চমানের প্রোটিন রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ১৮-২০ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। প্রোটিন ছাড়াও এই মাছে আরো অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
ঈল মাছের পুষ্টিগুণঃ
- প্রোটিন
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড
- ভিটামিন A
- ভিটামিন D
- ভিটামিন E
- আয়রন
- ক্যালসিয়াম
- জিঙ্ক
ঈল মাছের স্বাস্থ্য উপকারিতাঃ
- দেহের শক্তি বৃদ্ধি করে
- হৃদযন্ত্র ভালো রাখে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
- দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে
- হাড় মজবুত করে
- ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে
- মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
- হজম শক্তি বৃদ্ধি করে
ঈল মাছের প্রজাতি ও বৈশিষ্ট্য
ঈল মাছের প্রজাতি এবং বৈশিষ্ট্য তাদের বাসস্থান, শারীরিক গঠন এবং খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। নিচে ঈল মাছের প্রধান এবং পরিচিত কিছু প্রজাতি এবং তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
বৈদ্যুতিক ঈল (Electric Eel)
বৈজ্ঞানিক নাম: Electrophorus electricus
বৈশিষ্ট্য: ঈল এর সব প্রজাতির মধ্যে এটি অনেক জনপ্রিয়। এর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ হলো এই মাছের বৈদ্যুতিক ক্ষমতা। এরা বৈদ্যুতিক শক উৎপন্ন করতে সক্ষম। শিকার ধরতে এবং নিজেদের রক্ষার জন্য এরা ৬০০ ভোল্ট বা তার বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে।
দৈর্ঘ্য: প্রায় ২.৫ মিটার (৮ ফুট) পর্যন্ত হতে পারে।
বাসস্থান: দক্ষিণ আমেরিকার নদী এবং জলাভূমি।
মোরে ঈল (Moray Eel)
বৈজ্ঞানিক নাম: Gymnothorax
বৈশিষ্ট্য: এদের রং উজ্জ্বল এবং চামড়া মসৃণ। এরা সাধারণত প্রবাল প্রাচীরের কাছে লুকিয়ে থাকে।
দৈর্ঘ্য: ১.৫ মিটার (৫ ফুট) পর্যন্ত প্রায়।
বাসস্থান: উষ্ণ সামুদ্রিক পরিবেশে। বিশেষ করে সমুদ্রের প্রবাল অঞ্চলে।
আমেরিকান ঈল (American Eel)
বৈশিষ্ট্য: এরা মিঠা পানি এবং লবণাক্ত পানি, উভয় ধরনের পানিতে বসবাস করতে পারে। তবে এরা প্রজননের জন্য সমুদ্রে ফিরে যায়।
দৈর্ঘ্য: প্রায় ১ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
বাসস্থান: উত্তর আমেরিকার নদী এবং সমুদ্রতে।
ইউরোপীয় ঈল (European Eel)
বৈজ্ঞানিক নাম: Anguilla anguilla
বৈশিষ্ট্য: জীবনের প্রথম দিকে লার্ভা হিসেবে সমুদ্রের গভীরে থাকে এবং পরবর্তীতে নদীতে চলে আসে।
দৈর্ঘ্য: প্রায় ১ মিটার।
বাসস্থান: ইউরোপ এবং উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলের নদী এবং সমুদ্র।
কুচিয়া/কুচে
বৈজ্ঞানিক নাম: Monopterus cuchia
বৈশিষ্ট্য: অতিরিক্ত পিচ্ছিল চামড়া। ফুসফুস ও ত্বক দিয়ে শ্বাস নিতে পারে। কাদামাটিতে বাস করতে পছন্দ করে।
দৈর্ঘ্য: ২০ - ৭০ সেমি
রং: গাঢ় বাদামী থেকে কালো
ঈল মাছের জীবনচক্র
ঈল মাছের জীবনচক্র শুরু হয় ডিম থেকে। প্রজননের সময় ঈল মাছ গভীর সমুদ্রে ডিম পাড়ে। ডিম খুব ক্ষুদ্র, স্বচ্ছ এবং জলের ওপর ভাসমান থাকে। পরবর্তীতে ডিম ফুটে লার্ভা জন্মায়। যা লেপ্টোসেফালাস (Leptocephalus) নামে পরিচিত। লার্ভা ফিতা আকৃতির এবং স্বচ্ছ হয়, এদের দেহ পাতলা ও চ্যাপ্টা।
সমুদ্র থেকে মিষ্টি পানিতে পৌছানোর সময় লার্ভা "গ্লাস ঈল" এ রূপান্তরিত হয়। গ্লাস ঈল পরে "এলভার" এ রূপান্তরিত হয়। এই পর্যায়ে এদের রং ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে। এরপর এলভার প্রাপ্তবয়স্ক ঈল বা "ইয়েলো ঈল" এ পরিণত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ঈলের দেহের রং হলুদ বা বাদামি হয়।
জীবনের শেষ পর্যায়ে প্রাপ্তবয়স্ক ঈল "রূপালী ঈল" এ পরিণত হয়। এসময় দেহের রং রূপালী হয়ে যায় এবং এরা প্রজননের জন্য প্রস্তুত হয়। প্রজননের জন্য ঈল মাছ গভীর সমুদ্রের নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে যায় এবং ডিম পাড়ার পর প্রাপ্তবয়স্ক ঈল মারা যায়।
ঈল মাছের খাদ্যাভ্যাস
ঈল মাছ মাংসাশী প্রাণী এবং এদের খাদ্যাভ্যাস তাদের প্রজাতি, আবাসস্থল এবং শিকার ধরার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। এরা সাধারণত রাতের বেলা খাবার সংগ্রহ করে। এদের খাবার তালিকায় থাকা প্রধান কিছু খাবার নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
- ক্ষুদ্র মাছ
- চিংড়ি ও শামুক
- কাকড়া
- কীটপতঙ্গ ও লার্ভা
- প্লাংকটন ও জৈব বস্তু, ইত্যাদি
ঈল মাছ দ্রুত গতিতে শিকার ধরতে পারে। বেশিরভাগ ঈল রাতে শিকার করে। এরা পরিবেশ অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে।
ঈল মাছ রান্নার রেসিপি
ঈল মাছের দাম অনেক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে তেমন একটা ঈল মাছের রেসিপি চোখে পড়ে না। তবে ঈল মাছের বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় রেসিপি রয়েছে। যেমন, ঈল মাছ ভুনা, ঈল মাছ ভাজা, ইত্যাদি। এরমধ্যে আমরা আজকে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে সহজ ঈল মাছ ভাজার রেসিপি সম্পর্কে জানবো।
উপকরণঃ
- ঈল মাছ
- হলুদ গুঁড়া
- লবণ
- তেল
- মরিচ গুঁড়া
প্রস্তুত প্রণালীঃ
মাছ ভালোভাবে পরিষ্কার করে কেটে টুকরো করুন। এবার, কেটে রাখা মাছের সাথে পরিমাণ মতো হলুদ, লবণ, মরিচ মাখিয়ে ১০ মিনিট রেখে দিন। এরপর একটা ফ্রাই প্যানে তেল গরম করে নিতে হবে। অতঃপর গরম তেলে মাখিয়ে রাখা মাছ ভেজে নিন এবং গরম গরম পরিবেশন করুন।
ঈল মাছের দাম
২০১৮ সালে সাপের মতো দেখতে ১ কেজি ঈল মাছের বাচ্চার দাম উঠেছিলো প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর প্রতি কেজি পূর্ণবয়স্ক মাছ বিক্রি হয় প্রায় ২৫০ মার্কিন ডলারে।
ঈল মাছের অনেক প্রজাতি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণত এক ধরনের ঈল পাওয়া যায়, সেটি হলো কুচিয়া/কুচে। বাংলাদেশে কুচিয়ার দাম আকার, ওজন এবং বাজারের অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশে প্রতি কেজি ঈল মাছের (কুচিয়ার) বর্তমান বাজার দর ৬০০ - ৮০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে কিছু প্রজাতির ঈল মাছের দাম অনেক বেশি হতে পারে উদাহরণস্বরূপ কিছু ক্ষেত্রে ১ কেজি ঈল মাছের দাম ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ঈল মাছের চাহিদা ও রপ্তানি মূল্য ভিন্ন হয়। ঈশ্বরদী থেকে কুচিয়া মাছ থাইল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এখানে কমেন্ট করুন
comment url