ডেথ ভ্যালি (Death Valley) বা, মৃত্যু উপত্যকা। বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান
ডেথ ভ্যালি (Death Valley) কোথায় অবস্থিত?
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া (California) এবং নেভাদা (Nevada) অঙ্গরাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত অঞ্চল ডেথ ভ্যালি। বছরের বেশিরভাগ সময়ই অসহনীয় গরম থাকে সেখানে।
১৯১৩ সালের ১০ জুলাই ডেথ ভ্যালির ফার্নেস ক্রিক (Furnace Creek) নামক জায়গায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৩৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) রেকর্ড করা হয়েছিল। উষ্ণতা ও তাপমাত্রার সাক্ষী হতে প্রতি বছরই সেখানে ভিড় জমাচ্ছে পর্যটকরা।
ডেথ ভ্যালির রহস্যময় পাথর (এই পাথরগুলো নিজেরাই চলাচল করে)
পোস্টসূচীপত্রঃডেথ ভ্যালির "রেস ট্রাক" নামক অঞ্চলে প্রাকৃতিক পাথর সমূহের রহস্যজনকভাবে চলাচল লক্ষ্য করা যায়। যদিও প্রথমদিকে কেউ এদের চলাচল সরাসরি দেখেনি। তবে ২০১৪ সালের দিকে কেউ একজন এ রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়।
ডেথ ভ্যালির এই রহস্যময় চলন্ত পাথরের রহস্য উন্মোচন নিয়ে আমাদের ওয়েবসাইটেই বিস্তারিত একটি ব্লগ পোস্ট করা আছে। আপনারা চাইলে সেটি এই লিংকে ক্লিক করে দেখতে পারেন – রহস্যময় চলন্ত পাথর
ডেথ ভ্যালি কেন এতো গরম থাকে?
পৃথিবীর সবচেয়ে গরম স্থান হলো ডেথ ভ্যালি। প্রতি বছর গ্রীষ্মে এর গরমের মাত্রা আগের থেকে বেড়েই চলেছে। ডেথ ভ্যালি গরম হওয়ার পেছনে বেশকিছু ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত কারণ রয়েছে
ডেথ ভ্যালির অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৬ মিটার নিচে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচে অবস্থান করায় সেখানে বায়ুর চাপ অনেক বেশি থাকে, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তাছাড়া ডেথ ভ্যালির চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড় থাকার কারণে ঠান্ডা বাতাস সেখানে ঢুকতে পারে না, ফলে ভেতরের তাপমাত্রা ভেতরেই আটকে থাকে। এখানে আদ্রতার পরিমাণ খুবই কম থাকে। এখানে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে এবং তা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে, ফলে এখানকার মাটি ও পাথরকে অনেক গরম করে তোলে। ইত্যাদি আরো অনেক কারণে এই স্থানটি বছরের বেশিরভাগ সময়ই গরম বা উত্তপ্ত থাকে।
ডেথ ভ্যালির ইতিহাস
ডেথ ভ্যালি নামটি এসেছে ১৮৪৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশের সময় থেকে। ঐ সময়ে সোনা খোঁজার উদ্দেশ্যে অনেকেই এই জায়গায় এসেছিলো। কিন্তু এখানকার বৈরী আবহাওয়ার কারণে তারা টিকে থাকতে পারেনি। এই অঞ্চলের কঠোর পরিবেশের কারণে তারা একে "ডেথ ভ্যালি" নামে ডেকে ওঠেন।
ডেথ ভ্যালিতে প্রাচীন আদিবাসী আমেরিকান পায়ুটে (Paiute) এবং টিম্বিশা শোশোনি (Shoshone) জাতি বসবাস করতো। ১৮৮০ সালে এখানে বোরাক্স (Borax) খননশিল্প শুরু হয়।
ডেথ ভ্যালি ভ্রমণের সেরা সময়
ডেথ ভ্যালি ভ্রমণের জন্য খেয়াল করতে যখন তাপমাত্রা কম থাকবে তখন যাওয়ার জন্য। কেননা তাপমাত্রা বেশি থাকলে আপনি সেখানে থাকতে পারবেন না। তাহলে আসুন জেনে নেওয়া যাক ডেথ ভ্যালিতে কখন তাপমাত্রা কম থাকে বা ডেথ ভ্যালিতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় কোনটি
আপনি মার্চ - এপ্রিলের মধ্যে ডেথ ভ্যালিতে যেতে পারেন। এসময়ে সেখানে দিনের বেলা তাপমাত্রা থাকতে ২৫-৩৫°C। এসময়ে সেখানকার মরুভূমিতে বুনোফুল ফোটে। এই ফুল মরুভূমির বিশেষ আকর্ষণ।
অথবা, আপনি অক্টোবর - নভেম্বরে মধ্যে যেতে পারেন। এই সময়ে ডেথ ভ্যালিতে দিনের বেলা তাপমাত্রা থাকে ২৫ - ৩০°C এবং রাতের বেলা হালকা ঠান্ডা থাকে।
আপনি যদি একেবারেই গরম সহ্য না করতে পারেন কিংবা আপনার যদি ঠান্ডা পছন্দ হয়, তাহলে আপনি ডিসেম্বর - ফেব্রুয়ারির মধ্যে যেতে পারেন। এই সময়ে ডেথ ভ্যালির তাপমাত্রা থাকে দিনের বেলাতে ১৫ - ২০°C এবং রাতে অনেক শীতল হতে পারে।
ডেথ ভ্যালি হাইকিং ট্রেইল (Hiking trails)
ডেথ ভ্যালির ন্যাশনাল পার্কে বেশ কয়েকটি অসাধারণ এবং বৈচিত্র্যময় হাইকিং ট্রেইল রয়েছে। এরমধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি হাইকিং ট্রেইল সম্পর্কে নিচে জানানো হলোঃ
- গোল্ডেন ক্যানিয়ন ট্রেইল – এটার অবস্থান ডেথ ভ্যালির গোল্ডেন ক্যানিয়নে। গোল্ডেন ক্যানিয়ন ট্রেইলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৫ মাইল। আপনি ১ ঘন্টার মধ্যেই এটি শেষ করতে পারবেন।
- মোজাইক ক্যানিয়ন ট্রেইল – এটির অবস্থান স্টোভ ওয়েলসের কাছেই। মোজাইক ক্যানিয়ান ট্রেইলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২ মাইল। অ্যাডভেঞ্চার লাভারদের জন্য দুর্দান্ত একটি ট্রিপ টি।
- যাব্রিসকি পয়েন্ট থেকে ব্যাডল্যান্ড লুপ ট্রেইল – এই ট্রেইলের অবস্থান যাব্রিসকি পয়েন্টে। এখান থেকেই এই ট্রেইলের শুরু হয়। যাব্রিসকি পয়েন্ট থেকে ব্যাডল্যান্ড লুপের দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৭ মাইল। এখান থেকে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
- ড্যান্টেস ভিউ ট্রেইল – এটির অবস্থান ড্যান্টেস ভিউ নামক অঞ্চলে। এই ট্রেইলের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫,৪৭৫ ফুট উঁচুতে।
- টেলিস্কোপ পিক ট্রেইল – এটি হলো ডেথ ভ্যালির সবচেয়ে বড় ট্রেইল। এর অবস্থান মেহাভি রেঞ্জে। এই ট্রেইলের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ মাইল। এটি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ট্রেইলগুলোর মধ্যে একটি।
ডেথ ভ্যালিতে এ পর্যন্ত কতজন মারা গেছে?
ডেথ ভ্যালির তীব্র তাপমাত্রা এবং প্রতিকূল পরিবেশের কারণে এখানে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু, ঠিক কতজন মানুষ এখানে মারা গেছে সেটার নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়নি। তবে, আনুমানিক ভাবে বলা যায় প্রায় শতাব্দী ধরে কয়েকশত মানুষ এখানে মারা গেছে।
ডেথ ভ্যালিতে কোনো প্রানী বা গাছপালা আছে কি?
ডেথ ভ্যালি পৃথিবীর সবচেয়ে গরম জায়গা গুলোর মধ্যে অন্যতম। তারপরও এখানেও কিছু প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদ রয়েছে।
ডেথ ভ্যালি তে যেসব উদ্ভিদ রয়েছে
- ক্রেসোট গাছ
- মেসকুইট গাছ
- ক্যাকটাস
- ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার
ডেথ ভ্যালিতে যেসব প্রানী রয়েছে
- কোয়েট
- ববক্যাট
- মহাকান্টারী পাখি
- বাদুর
- কয়েক প্রজাতির সাপ এবং টিকটিকি
এছাড়াও আরো কিছু ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে এখানে।
ডেথ ভ্যালিতে যেসব সিনেমা তৈরি করা হয়েছে
ডেথ ভ্যালিতে বেশকিছু চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ তৈরি করা হয়েছে। ডেথ ভ্যালির প্রাকৃতিক দৃশ্য বিভিন্ন গ্রহ এবং মরুভূমির পরিবেশ তৈরি করতে সহায়তা করে। বিশেষ করে, "স্টার ওয়ার্স" সিরিজের কয়েকটি অংশে ডেথ ভ্যালি ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়াও "রিটার্ন অফ দ্য জেডাই" চলচ্চিত্রে টাটুইন গ্রহরের দৃশ্যতে ডেথ ভ্যালি ব্যবহৃত হয়েছে।
ডেথ ভ্যালিতে যাওয়ার আগে যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত
ডেথ ভ্যালি যেহেতু পৃথিবীর সবচেয়ে গরম ও শুষ্ক জায়গা গুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এখানকার বৈরী আবহাওয়ার কারণে এখানে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর। তাই সেখানে যাওয়ার আগে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা হলোঃ
প্রথমত এখানে যাওয়ার জন্য অবশ্যই সঠিক সময় নির্ধারণ করতে হবে। ডেথ ভ্যালিতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় নিয়ে আমরা উপরেই আলোচনা করেছি। সাথে অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি রাখতে হবে। সহজে পঁচে না এমন কিছু শুকনো খাবার সাথে রাখবেন। যে গাড়িতে যাবেন, সেই গাড়ির সমস্ত কিছু চেক করবেন এবং অবশ্যই গাড়ির ফুয়েল ট্যাঙ্ক পুরোপুরি ভর্তি রাখুন। প্রয়োজনে অতিরিক্ত ফুয়েল সংগ্রহে রাখুন। গরমে টিকে থাকা যায় এমন পোশাক যেমন, হালকা রঙের ঢিলাঢালা সুতির পোশাক পরে যাবেন।
সাথে সানগ্লাস, হ্যাট এবং সানস্ক্রিন নিতে ভুলবেন না। ইমার্জেন্সি সরঞ্জাম হিসেবে ফার্স্ট এইড বক্স, টর্চ লাইট, অতিরিক্ত ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যাবেন। ঐখানের বেশ কিছু জায়গাতে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না, এক্ষেত্রে আপনি সাথে করে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ডিভাইস রাখতে পারেন। চিহ্নিত রাস্তা ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। বন্যপ্রাণী থেকে সাবধানে থাকবেন। গরমের কারণে দিনের বেলা কম বের হওয়ার চেষ্টা করবেন, ভোরে বা সকালে এবং বিকেলে বা সন্ধ্যার আগে ঘোরাঘুরি করবেন।
সবশেষে, আপনার ভ্রমণ নিরাপদ এবং আরামদায়ক হোক।
এখানে কমেন্ট করুন
comment url